
করোনাভাইরাসের ভয়াল পরিস্থিতির মাঝে সীমান্ত জেলা কক্সবাজার লকডাউন থাকার পরও ইয়াবা কারবারিরা থেমে নেই। গোপনে নিত্য নতুন কৌশল ও পাচারের পথ পরিবর্তন করে তাদের কারবার এখনো চলছে। রাতের আঁধারে নাফনদ পাড়ি দিয়ে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে ইয়াবার বড় চালানগুলো।
দেশের দক্ষিণ-পূর্ব স্থলভাগের সর্বশেষ ভূমি টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ঘোলার চর এখন ইয়াবা কারবারিদের নতুন ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হয়েছে। একসময় মালয়েশিয়া মানবপাচার এবং রাখাইন সংকটে রোহিঙ্গা পাচারেরও অন্যতম ট্রানজিট ঘাটে পরিণত হয়েছিল ঘোলার চর। নাফনদ ও বঙ্গোপসাগরের মোহনা ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই চরের পাশে রয়েছে প্রায় অর্ধশত পরিবারের বসতি। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা পাচারকারীদের নৌকাগুলো ঘোলার চরে নোঙর করে খালাস করা হয় ইয়াবার বড় চালান। পরে খালাস করা ইয়াবাগুলো পাশের ঘরবাড়িগুলোতে গুদামজাত করা হয়।
এক সময়ে নাফনদের সীমান্তে টেকনাফের সদর ইউনিয়নের জালিয়া পাড়া, নাজির পাড়া, পৌরসভার নাইট্যংপাড়া, হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুড়া, হোয়াইক্যং উনচিপ্রাং ইয়াবা পাচারের নিরাপদ পয়েন্ট হিসেবে পরিচিতি ছিল। কিন্তু সেসব পয়েন্টে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারির কারণে ইয়াবা পাচারকারীরা এখন কৌশলে ইয়াবা খালাসের স্থান পরিবর্তন করেছে। ইয়াবা কারবারিদের কাছে এমুহুর্তে সবচেয়ে সুবিধাজনক ইয়াবা পয়েন্ট ঘোলার চর। চরের পাশে বসতি স্থাপন করা ঘোলার পাড়া ও দক্ষিণ পাড়ার একটি সিন্ডিকেট পাচারকারীদের ইয়াবা খালাসে কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে বলেও জানা গেছে।
শাহপরীর দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাঠের নৌকা বা ফিশিং ট্রলারে করে আসা ইয়াবার চালান গুলো কারবারিদের কাছ থেকে প্রতি পিস পাঁচ টাকা থেকে দশ টাকা চুক্তিতে খালাস করে দেয় সংঘবদ্ধ পাচারকারী সিন্ডিকেটের লোকজন। এই সিন্ডিকেট সদস্যদের প্রত্যেকের বাড়ি ঘোলার চরের পার্শবর্তী হওয়ায় ইয়াবার চালান খালাস হওয়ার পর দেশে পাচারের পরিস্থিতি সুবিধাজনক না হওয়া পর্যন্ত তাদের বাড়িতে মজুদ রাখা হয়। পরে সময়মত কারবারিরা লোক দিয়ে এসব ইয়াবা তাদের গন্তব্যে নিয়ে যায়। ইয়াবা খালাসের নতুন ট্রানজিট পয়েন্ট ঘোলার চরের ইয়াবা পাচার ও খালাস সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন, দক্ষিণ পাড়া- ঘোলার পাড়ার আব্দু শুক্কুরের তিন ছেলে মোহাম্মদ হোছন ওরফে মিড়া মাছন, নবী হোছন, ইমান হোছন ও জাহেদ হোছন। এছাড়া একই এলাকার ওমর মিয়ার ছেলে মো. কাশেম, মৃত উলা মিয়ার ছেলে হাফেজ উল্লাহ, পুরাতন রোহিঙ্গা আয়ুব মাঝি, মিস্ত্রি পাড়ার মোজাহের আলম ওরফে কালাবাশি, ডাংগর পাড়ার মো. ইউনুছের ছেলে আব্দুল মান্নান, মৃত. আবু শামার ছেলে মো. ফিরোজ, মাঝের পাড়ার সোলতান আহমদ লেড়–র ছেলে মো. রফিক, মিস্ত্রি পাড়ার মৃত এখলাসের ছেলে শামসুল আলম ওরফে শামসু।
দক্ষিণ পাড়ার বাসিন্দা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী জানান, ইয়াবা পাচার ও খালাস চক্রের এই সদস্যরা স্থানীয়দের বাঁধা এড়াতে বিভিন্ন সময়ে নিজেদের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের কাছের লোক বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন।
টেকনাফ মডেল থানা পুলিশের ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, সীমান্তের ইয়াবা কারবারিদের একটি অংশ দুই দফায় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করেছেন। বেশ কয়েকজন ইয়াবা কারবারি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। এছাড়া আটক রয়েছেন অনেকেই। এরপরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এখনো যারা ইয়াবা কারবার বন্ধ করেনি, তাদের কঠোর হাতে দমন করা হবে এবং অচিরেই আইনের আওতায় আনা হবে।
এদিকে গতকাল রবিবার ভোররাতে ইযাবার নতুন ট্রানজিট ঘাট খ্যাত ঘোলার চর পয়েন্ট থেকে দুই লাখ পিস ইয়াবার একটি বড় চালান উদ্ধার করেছে বিজিবি। এসময় বিজিবি ও ইয়াবা পাচারকারীদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। উভয় পক্ষের গোলাগুলিতে মো. জাফর আলম (৩০) নামে এক পাচারকারীর ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
এ প্রসঙ্গে টেকনাফস্থ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্ণেল মোহাম্মদ ফয়সল হাসান খান বলেন, নাফনদ অতিক্রম করে ইয়াবা পাচারকারীদের একটি নৌকা ঘোলার চরে ভিড়তে চেষ্টা করলে টহলরত বিজিবি সদস্যরা নৌকাটিকে চ্যালেঞ্জ করে থামার সংকেত দেয়। এসময় নৌকায় থাকা পাচারকারীরা বিজিবি সদস্যদের উপর গুলি বর্ষণ করলে বিজিবিও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায়। উভয়পক্ষের গোলাগুলিতে একজন ইয়াবা পাচারকারী নিহত হয়েছেন।