
কোভিড-১৯ ওরফে করোনা। এটি শুধু একটি নাম নয়, এটি গোলা বারুদের চেয়েও ভয়ঙ্কর এক মরণাস্ত্র। যার আঘাতে টালমাটাল সারা বিশ্ব। রেহাই পায়নি বাংলাদেশও। আমাদের বাংলাদেশের এই ক্রান্তিলগ্নে করোনার প্রতিরোধে জনগনকে সচেতন করতে সবসময় মাঠে থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাওয়া জনগণের এক অকৃত্রিম বন্ধুর নাম বাংলাদেশ পুলিশ।
সবাই যখন করোনা’র মতো রোগের এই সময়ে বাড়িতে থাকতে পারে কিংবা আত্মরক্ষায় সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে চলতে পারে ঠিক এই সময়টাতেও মাঠে থেকেই নিরবিচ্ছিন্নভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে পুলিশ বাহিনীর গর্বিত সদস্যরা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিয়ে ছুটে যাচ্ছে মানুষের বাড়ি বাড়ি।
পুরুষ পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি নারী পুলিশ সদস্যদের অবদান যেখানে অসামান্য। অধিকাংশ পরিবারে আমরা দেখে থাকি একজন নারী ঘরের সকল সাংসারিক কাজ সামলান এবং পুরুষ বাহিরে চাকরি/ব্যবসা করেন। কিন্তু যখন একজন নারীও চাকরি করেন তখন স্বভাবতই সাংসারিক কাজ সামলানো কিছুটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। আর সে চাকরি যদি হয় পুলিশ বাহিনীতে তাহলে তো রাষ্ট্রের কাজ সামলিয়ে আবার পরিবারের কাজ সামলাতে সে নারীদের অনেকটা হিমশিম খেতে হয় বলেই আমার ধারণা। করোনা সংক্রমণকালীন সময়ে পরিবারের সবাই যখন গৃহবন্দী তখন সেই নারীর-ও ঘরের প্রতি বিভিন্ন কর্তব্য থাকে আবার পুলিশের চাকরির সুবাদে রাষ্ট্রের প্রতিও থাকে বিভিন্ন দায়িত্ব।
একাধারে পরিবার এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব কিভাবে সামলান? ঠিক এইরকম একটি কমন প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছিলাম ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডি এম পি) পাঁচজন নারী পুলিশ অফিসারের কাছে। চলুন পড়ে নেই আমার প্রশ্নটি কি ছিলো?
আমার প্রশ্ন ছিলোঃ আপনি তো একজন নারী এবং একজন পুলিশ অফিসার। রাষ্ট্র এবং সংসার সন্তানের দায়িত্ব আপনার কাঁধে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে ঘর সামলিয়ে কীভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করছেন?
এবার পড়ে নেই তাদের উত্তরগুলো…
নাজমুন নাহার (অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, শ্যামপুর জোন, ডি এম পি) : যেহেতু আমার ছোট একটি বাচ্চা আছে। এই লকডাউনের সময় পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বাসায় অবস্থান করছে।সেইক্ষেত্রে আমার বাচ্চার দেখাশোনা পরিবারের সদস্যরাই করছে।আর আমিও সময় সুযোগ পেলে ফোন করে খবর নিচ্ছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য বুঝিয়ে বলছি ও উৎসাহিত করছি। আসলে এক্ষেত্রে পরিবারের সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের সহযোগিতায় এই ক্রান্তিকালে অনেকটা চিন্তামুক্তভাবে অফিস করতে পারি। তবে একটি অজানা আতঙ্ক-ও মনে বিরাজ করে। পেশাগত কারণে সারাদিন অফিস করছি, বিভিন্ন মানুষের কাছে ছুটে যাচ্ছি সেক্ষেত্রে লকডাউনে গৃহবন্দী আমার পরিবারের সকলের কাছে আমি ভাইরাসের নীরব বাহক হচ্ছি না তো..!
যদিও সবসময় সচেতনতার সাথে চলাফেরার চেষ্টা করি, মাস্ক, গ্লোভস পরিধান করি, বারবার হাত স্যানিটারাইজ করি। মোটকথা, স্বাস্থবিধি মেনে সতর্ক থাকার চেষ্টা করি। টাইমিং এর কথা যদি বলি তাহলে বলবো, চাকরি জীবনে পারিবারিক এবং পেশাগত কাজের টাইম মেইনটেইন করায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। আর কঠিন পরিস্থিতির কথা বললে বলবো, পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক না কেনো দেশের জন্যে কাজ করতে আমার পেশার কাছে, দেশের কাছে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং এই সময়ে দেশকে রক্ষা করা, দেশের জনগণের জন্যে কাজ করে যাওয়াই আমার প্রধান দায়িত্ব। এ দায়িত্ব থেকে আমি কখনো পিছু হটবো না।
মাহমুদা আফরোজ লাকী ( অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, দারুসসালাম জোন, ডি এম পি) : অবশ্যই এটা কঠিন। কারণ পরিবারের সবাই যখন নিরাপদ থাকার জন্য বাসায় অবস্থান করছে আমরা তখন বাইরে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আক্রান্ত হতে পারি করোনা নামক সংক্রামক রোগে। আবার আমরাই যেহেতু মা তাই অফিসের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাসায় সন্তান ও অন্যান্যদের যত্ন করার সময় তাদেরকে নিরব বাহক হয়ে আক্রান্ত করতে পারি। তাছাড়া এমন স্পর্শকাতর সময়ে সবাই যখন একধরনের আতংকের মধ্যে বসবাস করছে তখন আমরা বাইরে অতিরিক্ত সময় দিতে হচ্ছে বলে পরিবারের সদস্যদের সময় দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। তাই এসময় পরিবারের সদস্যদেরও আমাদের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে। তাই দায়িত্ব পালনের পর বাকি সময়টা খুব সুন্দরভাবে পরিবারের সবাইকে দিতে চেষ্টা করছি। তাদেরকে সবসময় সাহস যোগাচ্ছি পাশাপাশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার নির্দেশ দিচ্ছি। বাচ্চাদের তদারকি করছি কাছে থেকে বা ফোনে তারা যাতে কিচ্ছুক্ষণ পর পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়, চোখে মুখে অকারণে হাত না দেয়। পরিবারের সবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন-সিযুক্ত ফল, দুধ, ডিম ও শাক সব্জি খাওয়াতে চেষ্টা করছি। মোট কথা, ঘরে বাইরে দুদিকেই সতর্কতার সাথে কাজ করতে হচ্ছে।
আসমা আরা জাহান ( অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, ক্রাইম কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল, ডি এম পি): গুগোলে ব্যাবস্থাপনা বা পেশাদারিত্ব ইত্যাদি বিষয়ে সহজে বোঝার জন্য অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু সব কেমন যেন জটিল ভাবে বোঝানো হচ্ছে। তার চাইতে মনে হয় এ বিষয়গুলো ভালো ভাবে বুঝতে গেলে আমাদের দেশের নারীদের বিশেষ করে যারা আমার মত একই সাথে সামলাচ্ছেন সংসার, আত্নীয়তার দাবী এবং পেশাগত দায়িত্ব, তাদের একদিনের রুটিন যদি কেউ বোঝার চেষ্টা করে তাহলে ওই জটিল বিষয়গুলো অনেক সহজ হয়ে ধরা দিবে।
আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, এই সংকটের সময় পরিবার এবং রাষ্ট্র একসাথে কিভাবে সামলাচ্ছেন, উত্তরটা আমি কখনোই মেয়ে হিসেবে দিতে রাজি নই, উত্তর আমি দিতে চাই একজন মানুষ হিসেবে, বাংলাদেশ পুলিশের একজন সদস্য হিসেবে। আমি মনে করি আমার জীবনের বিভিন্ন প্রতিকূলতা থেকেই প্রাপ্ত শিক্ষা, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার অভিজ্ঞতা, আমার পেশাগত প্রশিক্ষণ ও পেশাদারিত্বটাই আমাকে এ সংকটে সাহস যোগায়। পরিবার-সমাজ-সংসার-পেশা কোনটাকেই তাই আমি মিলিয়ে ফেলি না। আমি জানি এ সংকট চিরদিন থাকবে না কিন্তু এখন সময় দেশকে বাঁচানোর, দেশের মানুষ বাঁচলে, বাঁচবে আমার পরিবার। তবে পেশাদারিত্বের মাঝেও মন খারাপ হয়, চিন্তা হয় আমার দেশের করোনা আক্রান্ত মানুষগুলোর জন্যে ।ইউনিফর্ম টা গায়ে দিয়ে সেই চিন্তা ঢাকার চেষ্টা করব আর দোয়া করব যাতে পৃথিবী সুস্থ হয়ে যায়, পৃথিবীর সব মানুষ ভালো থাকে।
জাকিয়া নুসরাত ( সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার, ক্যান্টনমেন্ট জোন, ডি এম পি) : একজন সরকারি কমকর্তা হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে নিজেকে দায়বদ্ধ মনে হয়। তাই সংসার সামলিয়েও জনগণের মাঝে পুলিশিং সেবা নিশ্চিত করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।
তাহ্সীনা আরিফ ( সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার, ট্রাফিক, মিরপুর জোন, ডি এম পি) : আমি প্রথমে একজন রাষ্ট্রের সেবক সেই সাথে নারী এবং একজন মা।দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে দেশকে রক্ষা করা আমার প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব। এই পরিস্থিতিতে নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার জন্য প্রত্যাহ একটু সকালে উঠে নিজের পরিবারের সমস্ত কাজ হাসবেন্ডের সহায়তায় সম্পন্ন করে কর্মস্থলে চলে যেতে হয় এবং রাষ্ট্রের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করি।
হ্যাঁ তারাই পুলিশ। পুলিশ বাহিনীর গর্বিত নারী সদস্য। তারা আমাদের সাধারণ পুরুষ মানুষদের চেয়ে অনেক বেশী সাহসী, বিচক্ষণ, দৃঢ় প্রত্যয়ী এবং জনগণের সেবায় নিয়োজিত। যেখানে আমরা সাধারণ পুরুষরা করোনার ভয়ে ঘরে লুকিয়েছি। সেখানে আমাদের নারী পুলিশ সদস্যদের এরূপ আত্মপ্রত্যয়ী বক্তব্য এ দেশকে নিয়ে আমাদের করোনামুক্ত নতুন দিনের স্বপ্ন দেখায়। তারা কিন্তু প্রথম থেকেই পিপিই,স্যানিটাইজারের চিন্তায় বসে না থেকে আর্ত-মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে নিয়মিতভাবেই। কোথাও কোন অসুস্থকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য মানুষ পাচ্ছেন না? পুলিশ ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।
বাজারে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতেও পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। তাদের নিয়মিত কাজের বাইরেও এই কাজগুলো করছে। এই সামাজিক স্বেচ্ছাশ্রমের কাজগুলি করতে কি পুলিশ আইগতভাবে বাধ্য?উত্তরটা না! তাহলে করছে কেন?এর উত্তর টা হল সামাজিক দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে, সামাজিক মানুষ হিসেবে। এটা তারা করে যাচ্ছেন এবং অব্যাহত থাকবে । অনেক সফল কাহিনী হয়তোবা আপনি জানেননা বা জানতেও চান না। তবে এতটুকু জেনে রাখুন, তারা নিজের পারিবারিক সকল কাজ সামলিয়ে, সন্তান স্বজন বাসায় ফেলে জনগণের পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে। স্যালুট জানাই বাংলাদেশ পুলিশের এই গর্বিত নারী সদস্যদের। স্যালুট জানাই আমার দৃঢ়চেতা মনোভাবের বড় বোনদের।
লেখকঃ শেখ রুমু, সহ-সভাপতি, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগ