এ পর্যন্ত দেশে প্রায় সাড়ে ৯০০ চিকিৎসাযোদ্ধারা করোনায় আক্রান্ত

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে লড়াই করছেন প্রায় দেড় লাখ চিকিৎসাযোদ্ধা; যাঁদের মধ্যে জেনে না জেনে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীদের সংস্পর্শে এসে সেবা দিতে গিয়ে প্রায় ৯৫০ জন চিকিৎসাযোদ্ধা নিজেরাই আক্রান্ত হয়েছেন। এ পর্যন্ত একজন চিকিৎসক ও দুজন চিকিৎসাকর্মী মারা গেছেন।

পরিস্থিতির শুরুর দিকে তাঁদের সুরক্ষাসামগ্রী নিয়ে অনেক সংকট থাকলেও এখন সেই সংকট প্রায় কেটে গেছে। তবু সাধারণ রোগীরা তথ্য গোপন করায় চিকিৎসাকর্মীরা প্রতিদিনই কেউ না কেউ সংক্রমিত হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য নির্বাচিত বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসাকর্মীদের চেয়ে অন্য হাসপাতালগুলোতে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন।

করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়া শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালটি করোনার ডেডিকেটেড হাসপাতাল নয়। অন্য সময়ের মতোই হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছিলাম। সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার করেই রোগীর কাছে গেছি, চিকিৎসা করেছি। ঠিক কিভাবে কখন সংক্রমিত হয়েছে বুঝতে পারিনি। উপসর্গ শুরু হওয়ার পর পরীক্ষায় রেজাল্ট পজিটিভ আসে। এর পর থেকে বাসায় আইসোলেশনে আছি। ইতিমধ্যে ১৪ দিন পার হয়ে গেছে। একটি টেস্ট নেগেটিভ এসেছে। আরেকটি টেস্ট করব। ওই টেস্টের রেজাল্ট নেগেটিভ আসার পরও আরো সাত দিন সতর্ক থাকতে হবে। তারপর অন্য রোগীদের সেবায় আবার আগের মতোই লেগে যাব।’

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ডাক্তার এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, ‘সপ্তাহখানেক ধরে চিকিৎসাকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা অনেকটাই কমে যাচ্ছে। এর আগে যেমন একসঙ্গে অনেকজন আক্রান্ত হয়েছেন, এখন তেমনটা নেই। গত দুই-তিন দিন ধরে এক-দুজন করে চিকিৎসক আক্রান্ত হচ্ছেন। এমন মহামারির পরিস্থিতিতে চিকিৎসক হিসেবে এটাকে স্বাভাবিক ধরতে হবে। তবু সবাইকেই যতটা সম্ভব সতর্ক থাকার জন্য আমাদের পক্ষ থেকেও বারবার সচেতন করছি। এর পরও যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন আমরা বিভিন্নভাবে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, তাঁদের চিকিৎসার খোঁজখবর নিচ্ছি।’

বিএমএ মহাসচিব বলেন, ‘সরকারের তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রণোদনার ব্যবস্থা করে রাখা আছে। এর পরও আমরা প্রতিদিনই তাঁদের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর রাখছি। এখন পর্যন্ত যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশের মতো আছেন হাসপাতালে, বাকি সব চিকিৎসকই নিজ বাসায় আইসোলেশনে আছেন।’

দেশে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মৃত একমাত্র চিকিৎসকের ব্যাপারে কী করা হচ্ছে জানতে চাইলে বিএমএ মহাসচিব বলেন, ‘তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। তাদের সবার করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হয়েছে, তবে কারো মধ্যেই সংক্রমণ শনাক্ত হয়নি। এ ছাড়া ওই পরিবারের বেশ কয়েকজন চিকিৎসক আছেন, তাঁরা নিজেরাও নিজেদের দেখভাল করছেন, সতর্ক থাকছেন। এ ছাড়া তাঁর স্ত্রী মানসিকভাবে এখনো বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেননি। যদিও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আর্থিক বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে আছে। সেদিক থেকে আপাতত আমাদের জায়গা থেকে তাঁদের জন্য বাড়তি কোনো আর্থিক সহায়তার এই মুহূর্তে প্রয়োজন নেই।’

অবশ্য ওই চিকিৎসক নেতা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত নার্স, ওয়ার্ড বয় ও ক্লিনারদের আক্রান্ত হওয়া নিয়ে। তাঁর মতে, নিচের পর্যায়ের কর্মীদের সুরক্ষার বিষয়টি এখনো সব ক্ষেত্রে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি। তাঁদের মাধ্যমে চিকিৎসকদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। এ ছাড়া ওই কর্মীদের আর্থিক ও পারিবারিক অবস্থানের দিক বিবেচনায় তাঁদের সুরক্ষার বিষয়টি অনেক বেশি জরুরি।

আরেক চিকিৎসক নেতা বাংলাদেশ স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডাক্তার ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও চিকিৎসক আক্রান্ত হচ্ছেন। আমরা খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। তাঁদের শারীরিক অবস্থা, চিকিৎসার পরিস্থিতি এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পারিবারিক অবস্থা জেনে যতটুকু সম্ভব সহায়তার চেষ্টা করছি।’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত সিনিয়র নার্স ও বাংলাদেশ স্বাধীনতার নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ইকবাল হোসেন সবুজ  বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের এই হাসপাতাল করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড হিসেবে কাজ শুরু হয়নি। তার আগেই কেবল এই হাসপাতালেই ৫২ জন নার্স আক্রান্ত হয়েছেন। এভাবে সারা দেশে এ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত নার্সের সংখ্যা ৩৫১, যাঁদের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ বা ২০ জন গতকাল পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন। বাকিরা কেউ কেউ বিভিন্ন হাসপাতালে, আবার কেউ নিজ নিজ বাসায় আইসোলেশনে রয়েছেন; যাঁদের সবারই পরিবারে এক ধরনের অন্ধকার পরিস্থিতি নেমে এসেছে। আমরা চেষ্টা করছি এসব পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সহায়তা করার। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে এটা করা সম্ভব হচ্ছে না।’

ওই নার্স নেতা বলেন, আক্রান্তদের বেশির ভাগই নন-কভিড হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেছেন। সন্দেহজনক উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের যেমন তাঁরা সেবা দিয়েছেন, আবার অনেক রোগী নিজেদের উপসর্গ চেপে গিয়ে কোনো কোনো হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার সময় চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যদের সংক্রমিত করেছে। এ ক্ষেত্রে প্রথম দিকে পিপিইর সমস্যা থাকলেও এখন তা অনেকটাই কেটে গেছে। তবু কোনো না কোনোভাবে নার্সরা সংক্রমিত হয়ে পড়ছেন রোগীদের খুব কাছে গিয়ে সেবা দেওয়ার জন্য। অনেকে হয়তো সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহার করলেও পর্যাপ্ত সতর্কতা না থাকার কারণে এমনটা হতে পারে।

অন্যদিকে চিকিৎসক, নার্স ছাড়াও মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট, স্বাস্থ্য সহকারীদের মতো অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। তাঁদের ভেতরেও দেড় শতাধিক এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসকদের তুলনায় তাঁদের আর্থিক সচ্ছলতা কম থাকায় এ পর্যায়ের আক্রান্তদের সহায়তায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে এগিয়ে আসা উচিত বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট পর্যায়ের নেতারা।