নিরামিষ খান পরিবেশ বাঁচান

আহমাদ মুদ্দাসসের: প্রাণীর প্রতি সহমর্মিতা মানুষের দীর্ঘদিনের। মানুষ যখন বনে  শিকার করতো, মানুষের বন্ধু হিসেবে সঙ্গী থাকতো কুকুর। “পেট” হিসেবে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের প্রাণী লালন-পালনের  প্রবণতা আছে। পোষা প্রাণীকে অনেকেই ভালো বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে।  অনেকেই এদেরকে নিজের সন্তান হিসেবেও ডেকে থাকেন !

প্রাণীর প্রতি সহানুভূতির জায়গা থেকে প্রাণীজ আমিষ ত্যাগ করে অনেকেই নিরামিষভোজি  বনে যাচ্ছেন। প্রাণী থেকে আহরিত আমিষ, যেমন ডিম, দুধ, মাছ, মাংস, দইয়ের মতো খাবারকে না বলছেন। নিজে প্রাণীজ প্রোটিন গ্রহণ করছেন না। শুধু উদ্ভিদ থেকে আহরিত খাদ্য গ্রহণ করছেন। অন্যকে গ্রহণ করতে উৎসাহ দিচ্ছেন। 

পশ্চিমে শুরু হয়েছে নিরামিষবাদ আন্দোলন। নিজে, পরিবারের সকল সদস্য, শিশু, এমনকি পোষা প্রাণী এই খাদ্যাভ্যাসে বাধ্য হচ্ছে।    

সারা পৃথিবীতেই ধীরে ধীরে এই প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। ভারতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আবরণে নিরামিষবাদ সামনে আসছে। ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে রেড মিট আগে থেকে অনেকেই গ্রহণ করতেন না। ভারতের রাজনৈতিক দল ভোটে জেতার আগে নিরামিষবাদের ব্যাপক প্রচার ঘটিয়েছিল। আঞ্চলিক পত্রিকাগুলো সবসময় বলতো, যে প্রদেশে বেশি নিরামিষাশী বাস করে, সেখানে বিজেপী বেশি ভোট পায়। যাদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ ভাগ।  জৈনদের মধ্যে নিরামিষ আহার করার প্রবণতা বেশি। অনেকেই এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছেন। বিনোদন জগতের মানুষদের  মধ্যে নিরামিষভোজী  হওয়ার প্রবণতা বেশি। 

নিরামিষবাদ আন্দোলনের মূল কথা শুধু প্রাণীজ আমিষ বর্জন করা না। প্রাণী থেকে তৈরি যে কোন পন্য বর্জন করাও এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন,  ডিম,  দুধ, মধু, চামড়ার পোষাক, জুতা বা ব্যাগ, সিল্কের কাপড়, ফার, উল, প্রসাধন, রাসায়নিক (যেগুলো  প্রাণীর ওপর পরীক্ষা করা হয়েছে)। প্রশ্ন হল, মানুষ কেন নিরামিষবাদে ঝুঁকছে? 

প্রাণীর প্রতি সহানুভূতি     

নিরামিষবাদিরা বিশ্বাস করে, মাংস উৎপাদনের জন্য প্রাণীকে যে পরিবেশে রাখা হয় সেটি অমানবিক।  কসাইয়ের ছুরি আর প্রাণীকে আধুনিক পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাতকরণ একইরকম নির্মম। ছোট্ট খাঁচার মধ্যে নড়াচড়ার জায়গা না রেখে হরমোনাল ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রাণীকে মোটাতাজা করা অমানবিক ও নিষ্ঠুর পদ্ধতি। প্রত্যেক প্রাণী যন্ত্রণা অনুভব করে। মৃত্যুর সময় কষ্ট পায়। সকল প্রাণীর মুক্তভাবে জীবন ধারণের অধিকার আছে। তাই প্রাণীকে শুধু মানুষের ক্ষুধা আর স্বাদ মেটানোর জন্য হত্যা করা অনুচিত বলে মনে করে তাঁরা। 

একটা গরু প্রায় ২৫ বছর বাঁচে। কিন্তু ফার্মের একটা গরু ৫ বছরের মধ্যেই কসাইখানায় চলে যায়। গ্রামে যেমন মুরগীকে সকালবেলা ছেড়ে দেওয়া হয়, সন্ধ্যায় খোপে ফিরে আসে, ফার্মে এমন সুযোগ নেই। গাদাগাদি করে সর্বক্ষণ আটকে রাখা হয় প্রাণীকে। আবার প্রাণীর যখন বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায় তখনই সেটিকে মেরে ফেলা হয়। নিরামিষবাদিরা নৈতিকতার জায়গা থেকে নিরামিষাশী হন। 

পরিবেশগত কারণ

জলবায়ু পরিবর্তন এখন পৃথিবীর মানুষের সব থেকে বড় চিন্তার কারণ।  যদিও যুক্তরষ্টের মতো দেশ প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেড়িয়ে গেছে। তবু সাধারণ মানুষ দিনেদিন সচেতন হচ্ছে। নিরামিষবাদিরা  বিশ্বাস করে, মাংস উৎপাদনের  জন্য প্রাণী পালন পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। প্রাণীদের খাদ্য উৎপাদন করতে অনেক বেশি জমির প্রয়োজন হয়। অনেক পানির প্রয়োজন হয়। জমিতে সার ও কীটনাশক দেওয়ায় জমির ওপর নির্ভরশীল প্রাণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বন উজার করে প্রাণীর চারণ ভূমি তৈরি করা হয়। প্রাণীর  খাবার উৎপাদন করা হয়। সারা পৃথিবীতে মানুষের ব্যবহারের প্রায় আট ভাগ পানি প্রাণী পালনে ব্যায় হয়। 

প্রাণী পালনে আবর্জনা তৈরি হয়। জলবায়ুর পরিবর্তন হয়।  কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়। ফার্মের প্রাণী প্রায় ১৮ ভাগ গ্রিনহাউজ গ্যাস তৈরি করে। যা যানবাহনের থেকে বেশি! নিরামিষবাদীরা মনে করে, মানুষ যদি শুধু শাক-সবজি আর ফলমূলের ওপর নির্ভর করে,  তবে চাষের জমি আরো ভালোভাবে ব্যবহার করা যাবে। প্রাণীকে খাওয়ানোর জন্য জমির প্রয়োজন হবে না।  সরাসরি জমিগুলো মানুষের খাদ্য যোগান দিবে। 

স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য

অনেক মানুষ শুধু স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যই নিরামিষাশী  হয়ে থাকেন।  বেশিরভাগ ক্ষেত্রে  শরীরের দরকারি  পুষ্টি উপাদানের জন্য প্রাণীজ আমিষের প্রয়োজন নেই। শাক-সবজি আর উদ্ভিদ থেকেই প্রায় সব ধরণের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়। শাক-সবজি আর ফলমূলে প্রাকৃতিকভাবে ফ্যাটের পরিমান কম থাকে। এতে প্রচুর পরিমাণে আঁশ, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই আছে। আমেরিকান ডায়েবেটিক সংস্থা জানিয়েছে, নিরামিষাশীদে স্থুলতা কম এবং তারা উচ্চরক্তচাপ থেকে মুক্ত থাকে। তারা টাইপ টু ডায়েবিটিস,  কোলন ক্যান্সার,  প্রোস্টেট ক্যান্সার এবং হৃদরোগে কম আক্রান্ত হয়।   

অনেকে ভাবেন, ছিপছিপে  শরীর বেশি সুন্দর, এজন্য আমিষ বর্জন করেন। আমাদের দেশে শুকিয়ে যাওয়াকে অনেকে স্বাস্থহানী হিসেবে বিবেচনা করেন।  বেশি বেশি খাওয়ার পরামর্শ দেন।  খাদ্যতালিকা নিয়ন্ত্রণ করে স্বাস্থ্য রক্ষা করা যায় বলে অনেকই নিরামিষাশী হয়ে উঠছেন। 

মানুষ মানুষের জন্য

নিরামীষবাদিরা মনে করেন, যখন তারা খাদ্য তালিকায় ফল-মূল আর সবজি রাখেন, যখন বাইরে খেতে গেলে লাল মাংস এড়িয়ে যান, প্রাণীজ আমিষের বদলে নিরামিষাশী আচরণ করেন তখনই তাঁরা মানুষকে সহায়তা করেন। প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ করেন। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ভূমিকা পালন করতে পারেন। দরিদ্র মানুষের প্রতি এক ধরণের সহমর্মিতা দেখান বলেও তাঁরা মনে করেন। নিরামিষের তুলনায় আমীষ জাতীয় খাবারের উচ্চমূল্য আছে। পৃথিবীর দরিদ্র মানুষেরা আমিষের যোগান দিতে পারেন না। সন্তানের মুখে দামি খাবার তুলে দিতে না পারায় কষ্ট পান। নিরামিষবাদিরা তাঁদের কর্মকাণ্ড এবং খাদ্যতালিকার মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ান, এমন ধারণার জন্যেও অনেকে নিরামিষাশী হন। 

নিরামিষাশী  হওয়ার সুবিধা অসুবিধা 

নিরামিষাশীরা বেশিদিন বাঁচেন। শুধু মাংস না খাওয়ার কারণেই তাঁরা বেশিদিন বাঁচেন এমন একটা ভুল ধারণা অনেকের আছে। মূলত খাদ্যতালিকা মেনে সকল পুষ্টি উপাদান গ্রহণের চেষ্টা করেন তারা। নিয়মিত ব্যায়াম করেন। ধুমপান ও মদ্যপান কম করেন।  যার ফলে সাধারণের তুলনায় তাঁরা অনেক বেশি বছর বাঁচতে পারেন। কখনো এটি পাঁচ থেকে দশ বছর!

ভিটামিন বি-১২ মূলত পাওয়া যায় মাছ-ডিম-দুধে। নিরামিষাশী মানুষ এসকল খাবার বর্জন করায় ভিটামিন ডি, বি-১২ ইত্যাদির অভাবে ভোগেন। অনেকেরই রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সাপ্লিমেন্ট হিসেবে এগুলো গ্রহণ করেন অনেকে। খাদ্যতালিকা ছোট হওয়ায় এবং অতি সাবধানতার কারণে স্বাস্থ্যহানীর সম্ভাবনাও থাকে।

কেউ কেউ আমিষ বর্জন করার কারণে নিরামিষভোজীদের  কটাক্ষ করেন। নিরামিষবাদীরা মনে করেন, নিরামিষ গ্রহণ করা একদমই নিজস্ব স্বাধীনতা আর ইচ্ছার ব্যাপার।  এখানে অন্যদের কিছু বলার থাকতে পারে না।

লেখক: সমাজকর্মী