
হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন বাংলাদেশের অভিনয়জগতের এক উজ্জ্বল তারা। তিনি শুক্রবার (২৯ মে) ৬৮ বছর ছুঁতেন; যদি আজ থেকে ৮ বছর আগে অর্থাৎ ২০১২ সালে পৃথিবী ছেড়ে চলে না যেতেন। সময় বিনোদনের পক্ষ থেকে শুভ জন্মদিন, বহুমাত্রিক অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি।
১৯৫২ সালের এই দিনে তিনি জন্মেছিলেন, ঢাকার নারিন্দায়। এই শিল্পী সম্পর্কে তার অগ্রজ শিল্পী আল মনসুর বলেছিলেন, ‘এ মাটিতে জন্ম নেওয়া সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চির উজ্জ্বল অভিনেতা হলো হুমায়ুন ফরীদি।’
হুমায়ুন ফরীদির বাবার নাম এটিএম নূরুল ইসলাম ও মা বেগম ফরিদা ইসলাম। চার ভাই-বোনের মধ্যে তার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। ইউনাইটেড ইসলামিয়া গভর্নমেন্ট হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি। মাধ্যমিক স্তর উত্তীর্ণের পর চাঁদপুর সরকারী কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
মঞ্চ থেকে অভিনয় ক্যারিয়ার শুরু তার। এরপর ছোটপর্দা কিংবা বড়পর্দা সব জায়গায় ছড়িয়েছেন তার গুণের মুঠো মুঠো সোনা। নান্দনিক অভিনয় নৈপুণ্যে হয়ে ওঠেন গুণী একজন অভিনেতা। অভিনয়গুণে কোটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি।
হুমায়ুন ফরীদির অভিনয়ের শুরুটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-বেরুনী হলে থাকতেন এ অভিনেতা। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় নাট্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নাট্যচার্য সেলিম আল দীনের নজরে পড়েন তিনি। এরপর যুক্ত হন ঢাকা থিয়েটারের নাট্যচর্চার সঙ্গে। ঢাকা থিয়েটারের হয়ে মঞ্চে অভিনয় করেন কিত্তনখোলা, মুন্তাসির ফ্যান্টাসি, কেরামত মঙ্গল, ধূর্ত উই প্রভৃতি নাটকে। কেরামত মঙ্গল নাটকে কেরামত চরিত্রে হুমায়ুন ফরীদির অভিনয় এখনও আলোচিত হয় ঢাকার মঞ্চে।
টিভি নাটকে হুমায়ুন ফরীদি আলোচনায় আসেন শহিদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল মামুন নির্মিত ‘সংশপ্তক’ ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে। নাটকটিতে কানকাটা রমজান চরিত্রে অভিনয় করে দারুণ প্রশংসা অর্জন করেন হুমায়ুন ফরীদি। এরপর দীর্ঘ সময় তিনি ছোটপর্দায় সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন।
হুমায়ুন ফরীদি অভিনীত উল্লেখযোগ্য টিভি নাটকের মধ্যে রয়েছে নিখোঁজ সংবাদ, হঠাৎ একদিন, পাথর সময়, সংশপ্তক, সমুদ্রে গাংচিল, কাছের মানুষ, মোহনা, নীলনকশাল সন্ধানে, দূরবীণ দিয়ে দেখুন, ভাঙ্গনের শব্দ শুনি, কোথাও কেউ নেই, সাত আসমানের সিঁড়ি, সেতু কাহিনী, ভবেরহাট, শৃঙ্খল, জহুরা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, প্রতিধ্বনি, গুপ্তধন, সেই চোখ, অক্টোপাস, বকুলপুর কত দূর, মানিক চোর, আমাদের নুরুল হুদা প্রভৃতি।
হুমায়ুন ফরিদী চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন ১৯৯০-এর দশকে। দীর্ঘ সময় সিনেমায় অভিনয় করে নিজেকে তুলে ধরেছেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস, দহন, লড়াকু, দিনমজুর, বীর পুরুষ, বিশ্বপ্রেমিক, আজকের হিটলার, দুর্জয়, শাসন, আনন্দ অশ্রু, মায়ের অধিকার, আসামী বধূ, একাত্তরের যীশু, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, প্রবেশ নিষেধ, ভণ্ড, অধিকার চাই, মিথ্যার মৃত্যু, ব্যাচেলর, শ্যামল ছায়া ও মেহেরজান প্রভৃতি।
সৃজনশীল কর্মযজ্ঞের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৪ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন হুমায়ুন ফরীদি। নাট্যাঙ্গনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাকে সম্মাননা প্রদান করে। পেয়েছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান মরনোত্তর একুশে পদক।
হুমায়ুন ফরীদি দুবার বিয়ে করেন। প্রথম বিয়ে করেন ১৯৮০-এর দশকে। শারারাত ইসলাম নামে হুমায়ুন ফরীদির একমাত্র মেয়ে রয়েছে প্রথম সংসারে। পরে প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফাকে তিনি বিয়ে করেন। ২০০৮ সালে তাদের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান এই গুণী অভিনেতা।