
যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যেও জরুরি সেবায় যুক্ত নাগরিকরা বাসের ভেতরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করছেন। ট্রান্সপোর্ট ফর লন্ডন সেখানে এই ব্যবস্থা পরিচালনা করে থাকে। ট্রান্সপোর্ট ফর লন্ডনের উপদেষ্টা কৃষানু চৌধুরী গতকাল বলেন, ‘লন্ডনের বাসে ৮৫ শতাংশ ও রেলপথে ৯৫ শতাংশ যাত্রী কমেছে। জরুরি স্বাস্থ্যকর্মী, সুপারস্টোরের কর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বাসে পরিবহন করা হচ্ছে। তাঁদের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে না। যানজট সৃষ্টি ও অন্যান্য চার্জও প্রত্যাহার করা হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব মানছেন ৭০ শতাংশ বাসযাত্রী। বাধ্যতামূলক করা না হলেও মাস্ক ব্যবহার বাড়ছে। আমরা নাগরিকদের অকারণে ভ্রমণ না করতে অনুরোধ করেছি। এ ছাড়া ব্যস্ততম সময়ে ভ্রমণ পরিকল্পনা পরিহার করে অন্য সময়ে তা করার পরামর্শও দিয়েছি।’
করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউন চলছে। কোথাও তা শিথিল আবার কোথাও তুলে দেওয়া হচ্ছে। তবে গণপরিবহনে মাস্ক ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব্ব বজায় রাখাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষজন কর্মস্থলে যাচ্ছে বা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানা সীমিত আকারে খুলে দেওয়া হয়েছে। দোকানপাট ও শপিং সেন্টার আগামী ১০ মে থেকে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। পোশাক কারখানাগুলোয় কর্মীদের পরিবহনের জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন-বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছিল বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ। পাবনা, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে পোশাককর্মীদের পরিবহনের জন্য এ চিঠি পাঠানো হয়েছিল গত মাসে। তবে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ তাতে সাড়া দেয়নি। বিআরটিসি সূত্রে জানা গেছে, স্বাভাবিক সময়ে সারা দেশে ২১টি ডিপোর অধীনে বিআরটিসির প্রায় এক হাজার ১৫০ বাস চলাচল করে। এর মধ্যে ঢাকা ও তার আশপাশে চলাচল করে আট শতাধিক বাস। করোনাকালে এসব বাস চলাচল বন্ধ আছে। বিআরটিসির এক হাজার ১০০ বাস বন্ধ থাকায় মাসে লোকসান হচ্ছে প্রায় ২৯ কোটি টাকা। গত ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি শুরুর পর থেকে করোনা চিকিত্সাকাজে যুক্ত চিকিত্সক, কর্মকর্তা ও সেবিকাদের
পরিবহনের জন্য বিআরটিসির ১৪টি বাস ব্যবহার করা হচ্ছে। তার মধ্যে আটটি বাস দোতলা। দোতলা বাসে আসন ৭৫টি। জানা গেছে, এসব বাসে চিকিত্সা কর্মকর্তা-কর্মীদের পরিবহন করা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে। বজায় রাখা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব্ব, যাত্রী ও চালকরা পরছেন মাস্ক। এ ছাড়া শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রাঙ্গণে নিয়মিত দুটি বাস সংরক্ষিত রাখা হচ্ছে। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের পরিবহনে সামাজিক দূরত্ব্ব বজায় রেখে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে এসব বাস পরিচালনা করা হচ্ছে। অনিয়মিতভাবে গতকাল পর্যন্ত করোনাকালে বিশেষ যাত্রীসেবায় জরুরি কাজে ব্যবহার করা হয়েছে বিআরটিসির ৪৫টি বাস।
এদিকে রাজধানী ঢাকায় লকডাউন ভেঙে পড়েছে আগেই। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুর, শ্যামলী, আগারগাঁও, বিজয় সরণির রাস্তায় অন্যান্য দিনের চেয়ে অটোরিকশা চলাচল বেশি চোখে পড়েছে। প্রাইভেট কার চলাচলও বেড়েছে। রিকশার চলাচল আগে থেকেই বেড়েছে। রিকশার চালকরা মিরপুর-১০ নম্বরসহ বিভিন্ন মোড়ে নিজেরা পারস্পরিক দূরত্ব্ব বজায় রেখে অবস্থান করছেন না। পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কঠোর হলে সামান্য সময়ের জন্য এসব চালক দুরত্বে অবস্থান করেন। মুখে মাস্কও পরেন না তাঁদের সবাই। গতকাল ৬০ ফুট সড়কে অটোচালক নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘জীবাণুনাশক আগে ছিটানো হতো। এখন আর কেউ ছিটায় না। মাঝেমধ্যে মাস্ক পরি, সব সময় পরি না।’ রিকশাচালক মধু মিয়া বলেন, ‘আগে ব্লিচিং পাউডার মেশানো পানি দিয়ে সিট মুছতাম, একজন যাত্রীর পর আরো একজন যাত্রী টানতে হয় তাই মুছে লাভ দেখতেছি না।’
আগামী ১০ মে দোকানপাট ও শপিং সেন্টার খুলে দেওয়া হলে ক্রেতাদের যাতায়াতের জন্য অটোরিকশাসহ ছোট যানবাহনের চলাচল বেড়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। তাতেও সামাজিক দূরত্ব্ব না মানার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। এ অবস্থায় বিআরটিসির সীমিতসংখ্যক বাসে সীমিত যাত্রী স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিবহন করার মধ্য দিয়ে এই করোনাকালে গণপরিবহন চালানোর অভ্যাস গড়ে তোলা যায় বলে মনে করেন পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ (খোকন)। তিনি বলেন, ‘করোনাকাল দীর্ঘ হলে পরিবহন চলাচল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে। এ জন্য অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, রিকশা ও অন্যান্য যানবাহনে জীবাণুনাশক ছিটানোর জন্য স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ আগের মতো আর তত্পর নয়। অটোরিকশায়ও জীবাণুনাশক ছাড়াই যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে।’
যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে প্রবাসী খায়রুল ইসলাম রোজেন কর্মস্থলে নিয়মিত চলাচল করেন ব্যক্তিগত গাড়িতে। তবে লন্ডনের গণপরিবহন বিশেষ করে বাস চলাচলের বিষয়টি নিয়ে তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, কর্মস্থলে যেতে গণপরিবহন হিসেবে বাস ব্যবহার করা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করে। করোনাকালে খাদ্যসামগ্রী কেনা ও শরীরচর্চার জন্য বাসা থেকে বের হতে পারছে মানুষজন। তবে তা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। লন্ডনে ৭ মের পর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে লকডাউন থাকবে কি না। জানা গেছে, যানবাহনে যাত্রী ও চালকদের মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন লন্ডনের মেয়র সাদিক খান।
কানাডার কুইবেক প্রদেশে থাকেন বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলায় জন্মলাভকারী শিল্পী হালদার। তিনি একটি কারখানায় কাজ করেন। এখন অবশ্য ‘ঘরবন্দি’ আছেন। আগামী ১১ মে থেকে তাঁকে কর্মস্থলে যেতে হবে। কারণ সেখানে ১১ মে থেকে সীমিত আকারে লকডাউন তুলে দেওয়া হচ্ছে। শিল্পী হালদার জানান, কর্মস্থলে যেতে হলে প্রতিদিন মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। তাই নিজের ঘরে বসেই এখন প্রতিদিন মাস্ক তৈরি করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি কুইবেক প্রদেশেই থাকি। সেখানে অফিস, কারখানা—সব কিছু খুলে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমরা করোনাকে জয় করে ফেলেছি। আসলে কি তাই? তবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। কারণ গণপরিবহনে মাস্ক পরতে হবে।’