
মানুষের জীবনের সাথে সমুদ্র যেন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে।পৃথীবীর প্রায় ৭১%হলো সমু্দ্র যা বিভিন্ন প্রাণীদের জন্য হলো একমাত্র বাসস্থান।ন্যাশনাল জিওগ্রাফীর এক তথ্যমতে সমুদ্র প্রায় ৭০% অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে।কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে আমাদের এই সমুদ্র প্রতিনিয়ত কোন না কোনভাবে দূষিত হচ্ছে।আর প্লাস্টিক দূষণ হলো তার মধ্যে অন্যতম যার ফলে জীববৈচিত্র এখন চরম হুমকির মুখে।পৃথিবীতে প্রতি মূহর্তে কোন না কোন স্থানে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোতল,পলিথিন,চিপসের প্যাকেট আর স্ট্র এর শেষ ঠিকানা হচ্ছে সমুদ্র।২০১৫ সাল নাগাদ, পৃথিবীতে ৬.৩ বিলিয়ন প্লাস্টিক পণ্য তৈরি করা হয়েছে। ভয়ংকর হলেও সত্য যে, এর মাত্র ৯ শতাংশকে পুনরায় ব্যবহার করা হয়েছে, ১২ শতাংশ পুড়িয়ে নষ্ট করা হয়েছে আর বাকি ৭৯ শতাংশই পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশে জমা আছে।এই জমা থাকা প্লাস্টিক কোন না কোনভাবে সমুদ্রে এসে পড়ছে।অপচনশীল এই প্লাস্টিক বছরের পর বছর সমুদ্রে ভাসতে থাকে আর ঢেউ এর মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায়।যার ফলে সমুদ্রের উপর একটা আচ্ছাদন তৈরি করে।সামুদ্রিক প্রাণীর একটি বড় অংশ সাধারণত খাদ্যের জন্য সমুদ্রে ভাসমান ক্ষুদ্র প্রাণিকণা (জুপ্ল্যাঙ্কটন) এবং উদ্ভিদকণার (ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন) উপর নির্ভরশীল।কিন্তু বিশ্ব জুড়ে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের একটা বড় অংশ যখন সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে, তখন তা বেশ ভয়ংকরভাবেই প্ল্যাঙ্কটন উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করছে।যার ফলে সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্য সরবরাহের প্রথম ধাপটিই বাধার মুখে পতিত হচ্ছে।আর কিছুকিছু প্লাস্টিক বোতল চাপের ফলে ভেঙ্গেভেঙ্গে ক্ষুদ্রকণায় পরিণত হচ্ছে যাকে আমরা মাইক্রোপ্লাস্টিক নামে অভিহিত করে থাকি।এই মাইক্রোপ্লাস্টিক হলো সাধারণ প্লাস্টিক অপেক্ষা আরো বেশি ক্ষতিকর।আকারে অতি ক্ষুদ্র হওয়ায় প্লাংকটন সাইজের এই প্লাস্টিক কে খাদ্য মনে করে খেয়ে ফেলছে সামুদ্রিক কিছু প্রাণী।আর এই মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রাণী দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পরিপাক ও প্রজনন এর মত গুরুত্তপূর্ন কাজকে বাধাগ্রস্থ করছে ফলে প্রাণীগুলো এগিয়ে যাচ্ছে বিলুপ্তির দিকে।ফ্রান্স আর অস্ট্রেলিয়ার উপকূল থেকে তিমিদের পরিপাকতন্ত্র থেকে প্রায় আটশত কেজির মতো প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। প্ল্যাঙ্কটন সাইজের এই প্লাস্টিককণাকে সামুদ্রিক মাছেরা যে খাদ্য মনে করে ভুল করছে, সে ব্যাপারটি ইতোমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে গবেষকদের কাছে।সামুদ্রিক কাছিমদের বেশিরভাগই পলিথিন ব্যাগ আর জেলিফিশ এর মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনা বলে তারা পলিথিন ব্যাগকে জেলিফিশ ভেবে খেয়ে ফেলছে।যার ফলে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে।
তাছাড়াও বিভিন্ন মাছের দেহে জমা হওয়া এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের দেহে চলে আসছে যা কান্সারের একটি অন্যতম কারণ।বিবিসির এক তথ্যমতে, গত মার্চে,ফিলিপাইনের সমুদ্রে ভেসে আসা একটি মৃত তিমির পেটে ৪০ কেজি (প্রায় ৮৮ পাউন্ড) পরিমাণ প্লাস্টিকের ব্যাগ পাওয়া গেছে যার মধ্যে ১৬টি চালের বস্তা এবং বিপুল পরিমাণ ‘শপিং ব্যাগ’ ছিল বলে উল্লেখ করেছে ডি-বোন কালেক্টর মিউজিয়ামের কর্মচারীরা।এছাড়াও গত বছরে থাইল্যান্ডে একটি তিমির মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল যেটি ৮০ কেজি পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যাগ গিলে ফেলায় মারা যায়। এরপর নভেম্বরে ইন্দোনেশিয়ায় একটি তিমি মাছের পাকস্থলীতে ১১৫টি কাপ, ৪টি প্লাস্টিকের বোতল, ২৫টি প্লাস্টিকের ব্যাগ এবং দুই জোড়া প্লাস্টিকের চপ্পল পাওয়া যায়।এ থেকে বুঝা যায় কতটা হুমকীর মুখে রয়েছে সামুদ্রিক প্রাণীগুলো।এছাড়াও সমুদ্রে চলে আসা এসব পলিথিন ব্যাগ,মাছ ধরার জাল এর অব্যবহৃত অংশ সামুদ্রিক প্রাণীগুলোর স্বাভাবিক চলাচলকে বাধাগ্রস্থ করছে ফলে হুমকির মুখে পড়ছে প্রাণীগুলো।সাম্প্রতিক এক গবেষণা মতে, সামুদ্রিক পাখিদের প্রায় নব্বই শতাংশ সরাসরি প্লাস্টিক দূষণের শিকার যা ষাটের দশকে ছিলো পাঁচ শতাংশের ও কম।তবে কিছুকিছু গবেষণার তথ্যমতে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সামুদ্রিক পাখির পাকস্থলীতেই পাওয়া যায় প্লাস্টিক।অ্যালবাট্রোসের মতো বড় সামুদ্রিক পাখিদের অবস্থা সবচেয়ে ভয়ংকর। সমুদ্র উপকূলে এই পাখিদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে।এদের মৃতদেহ হতে দেখা যায় ৮০% পাকস্থালী হলো প্লাস্টিক দ্বারা পূর্ণ যার মধ্যে আগুন জ্বালানোর কাজে ব্যবহৃত গ্যাসলাইটও রয়েছে।
শুধুমাত্র প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে প্রতি বছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী মারা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা যায় ২৬৭ প্রজাতির প্রাণী প্লাস্টিক দূষণের শিকার। এ ছাড়াও ৮৪ শতাংশ সামুদ্রিক কাছিম, ৪৪ শতাংশ সব ধরণের সামুদ্রিক পাখি এবং ৪৩ শতাংশ সামুদ্রিক প্রাণী শিকার হল প্লাস্টিক দূষণের।আর এই প্লাস্টিক দূষণ এর ক্ষতির প্রভাব শুধুমাত্র কম গভীরতার প্রাণীর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না।স্কটিশ এসোসিয়েশন ফর মেরিন সাইন্স তাদের গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন যে, সমুদ্রের প্রায় ২০০০ মিটার গভীরতায় থাকা প্রাণীদের ৪৮ শতাংশের পেটেই আছে প্লাস্টিক। এদের মাঝে অধিকাংশই হল পলিথিন এবং পলিসটার যা শপিং ব্যাগ এবং কাপড় থেকে নিঃসৃত।সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক গবেষণায় দেখা গেছে ওয়াশিং মেশিন থেকে প্রতি বছর ৩০ হাজার টন সিনথেটিক ফাইবার পানিতে মেশে যা সামুদ্রিক প্রাণীগুলো খাদ্য মনে করে খেয়ে ফেলছে ফলে তারা বিলিপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে।পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে প্রচারণা চালানো প্রতিষ্ঠান ওশ্যান কনসার্ভেন্সি ও ম্যাককিনসে সেন্টার ফর বিজনেস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর সমুদ্রে যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা হয় এশিয়ার পাঁচটি দেশ তার ৬০ শতাংশের জন্য দায়ী। দেশগুলো হলো—চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড।২০১৪ সালের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বছরে গড়ে মাথাপ্রতি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হয় ৩ দশমিক ৫ কিলোগ্রাম। ইউরোপের গড় মাথাপ্রতি বছরে ১৩৬ কিলোগ্রাম এবং উত্তর আমেরিকায় ১৩৯ কিলোগ্রাম। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের পরিমাণ কম হলেও নগরায়ণের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বাড়ছে সে পরিমাণ। কেবল প্লাস্টিক পণ্যের পরিমাণ নয়, বাংলাদেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহারবৈচিত্র্যও বাড়ছে।শুধু ২০১৬ সালেই ১১০ বিলিয়ন প্লাস্টিক বোতল বানিয়েছে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান কোমল পানীয় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কোকা-কোলা। আর এই বোতলের বেশিরভাগই উন্মুক্তভাবে পরিবেশে পরিত্যাগ করেছেন ভোক্তারা।যার শেষ ঠিকানা হলো সমুদ্র।ফলে সামুদ্রিক প্রাণীগুলো হুমকির মুখে।
এই ভয়াবহ হুমকি হতে সামুদ্রিক প্রাণীদের রক্ষা করতে হলে প্লাস্টিকের ব্যাবহার বন্ধ করা ছাড়া কোন বিকল্প নাই।
এছাড়াও পলিথিন ব্যাগের পরিবর্তে আমরা পাটের ব্যাগ বা কাগজের তৈরি ব্যাগ ব্যাবহার করতে পারি।আর প্লাস্টিক বোতল এর পরিবর্তে বাঁশের তৈরি বোতল আকৃতির চোঙ্ ব্যাবহার করা যেতে পারে বা টিনের পাত্র।ফলে এসব পচনশীল হওয়ায় সামুদ্রিক প্রাণীদের ওপর প্রভাব কিছুটা কমবে।তাছাড়াও প্লাস্টিকের পরিবর্তে পরীক্ষামূলকভাবে বায়োপ্লাস্টিক ব্যাবহার করা যেতে পারে।পরিশেষে বলবো আসুন আমরা সবাই প্লাস্টিক ব্যবহার কমে দিয়ে, যত্রতত্র না ফেলে সামুদ্রিক প্রাণীদের এই ভয়াবহ হুমকি হতে রক্ষা করি।আমাদের সচেতনতাই পারে পরিবেশটাকে সুন্দর করতে।
মোঃ ফারেশ হোসেন পাইলট
শিক্ষার্থী,মেরিন সায়েন্স
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়